BDNow24 News

ছেলেটা বাঘ বনে গেল

তাঁর জন্মের পর বেশি খুশি হয়েছিলেন দাদা সাত্তার মুন্সী। আনন্দে এবাড়ি-ওবাড়ি বলে বেড়িয়েছেন, 'আমার নাতি হয়েছে।' নাম রাখলেন 'রুবেল'। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নাদুসনুদুস। যে-ই দেখত গাল টিপে দিত। তাঁকে কোলে নেওয়ার জন্য ভাইবোনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি চলত। ছয় মাস বয়সে ছেলেটার একবার অসুখ করল। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছিল। বাড়িটায় নেমে এলো নিস্তব্ধতা। মা-বাবার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন মা। দেখেশুনে ওষুধ দিলেন। বললেন, আমি ওর একটা নাম দিই? মা আর না করলেন না। ডাক্তার রুবেলের নাম রাখলেন 'আলামিন'। তার পর থেকে দুটি নাম জোড়া লাগিয়ে তাঁর নাম হলো 'আলামিন রুবেল হোসেন'। তাঁদের গ্রামের নাম বাসামাটি। বাড়ির পাশে ধানক্ষেত। শীতে সেটি শরিষা ক্ষেত। ফড়িংয়ের পিছু পিছু ছুটতেন রুবেল। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতেন স্বপ্নরাজ্যে। একদিন মা বললেন, 'আব্বা, তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেব।' রুবেল খুশিও না, বেজারও না। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কেডস পায়ে গলিয়ে মায়ের সঙ্গে রওনা দিলেন স্কুলে। স্কুলের নাম রাহমানিয়া প্রাইমারি স্কুল। দিন কয়েকের মাথায় তিন-চারজন বন্ধুবান্ধব জুটে গেল। ক্লাসের ফাঁকে স্কুলের মাঠে খেলতেন তাঁরা। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় মায়ের কাছে বায়না ধরলেন, 'মা বল কিনে দাও!' বাবা জানলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে, তাই আলগোছে চুপিচুপি বাজার থেকে প্লাস্টিকের একটা বল কিনে দেন মা। স্কুলে যাওয়ার সময় ব্যাগের এক কোণে বলটা ঢুকিয়ে নিতেন। স্কুলে গিয়ে সারাক্ষণ খেলার ওপর থাকতেন। স্কুল থেকে একদিন অভিযোগ এলো, 'আপনার ছেলে তো স্কুলে পড়তে যায় না, খেলতে যায়!' বাবা মাছ ব্যবসায়ী। বাড়িতে থাকেন না। চট্টগ্রাম আর ভোলা থেকে মাছ আনেন। বড় ভাইয়েরা বাসায় থাকেন। একদিন সন্ধ্যার পর রুবেলকে রিমান্ডে নেওয়া হলো। তবু পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বলটি নিয়েই গেলেন। পরিবারের অন্যরা রুবেলকে শাসন করলেও মা তাঁকে 'লাই' দিতেন। মাকে আবার একদিন বললেন, 'টেনিস বল লাগবে।' তত দিনে রুবেল হাই স্কুলের ছাত্র। এলাকায় বোলার হিসেবে ভালো নাম হয়েছে। আশপাশের গ্রাম থেকে তাঁকে 'হায়ার' করা হতো। স্কুলে যাওয়ার পথে পাশের দোকানে স্কুলব্যাগ রেখে খেলতে যেতেন। খেলা শেষে ঠিকঠিকই স্কুল ছুটির সময় 'গুড বয়' হয়ে বাড়ি ফিরতেন। ক্লাস করা তাঁকে মোটেই টানত না। তাঁর ক্লাস ছিল মাঠে। ব্যাট-বলের সঙ্গে। তখন একটা ব্যাট দরকার ছিল। কিন্তু বাবার ভয়ে বাড়িতে বলতে পরেননি। অন্যের ধার করা ব্যাট দিয়ে খেলেছেন দীর্ঘদিন। তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয়ে বাগেরহাটের মেয়র খান হাবিবুর রহমান তাঁকে উন্মোচন ক্লাবে ভর্তি করে নেন। ছেলেটা বাঘ বনে গেলখেলাধুলায় ভালো বলে মা একটি কাঠের ব্যাট কিনে দেন। তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। নড়াইল, বাগেরহাট স্টেডিয়ামে খেলতে যেতেন। বোলিংয়ের কারণেই রুবেল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় হায়ারে ক্রিকেট খেলায় অংশ নেন। এর মধ্যে তৃণমূল থেকে ক্রিকেট প্রতিভা খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহযোগিতায় গ্রামীণফোন সারা দেশে পেসার হান্ট কর্মসূচির আয়োজন করে। সাতক্ষীরা গিয়ে তাতে অংশ নেন রুবেল। সর্বোচ্চ ৮২ মাইল গতিতে বল করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তখন থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রুবেলের নাম ছড়িয়ে পড়ে। অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দলে সুযোগ পান রুবেল। রুবেলের স্কুলজীবনের সহপাঠী মো. ফিরোজ জামান নাইম বলেন, সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা দুজনে বাগেরহাট বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমান নাম বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুল) পড়ালেখা করেছি। রুবেল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। রুবেল ভালো ব্যাটও চালাত। স্কুলজীবনেই রুবেলের বলের গতি এত বেশি ছিল যে বোলিংয়ের সময় শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যেত। ওর বলের কাছে ব্যাটসম্যানরা দাঁড়াতে পারত না। রুবেল বেশি খেলাধুলা করেছে তাদের বাসামাটি আমতলার মাঠে।
জামান নাইম আরো জানান, রুবেল গ্রামীণফোন পেসার হান্টে সুযোগ পেয়ে এক মাসের জন্য প্রশিক্ষণে বিদেশে যান। ২০০৬ সালে রুবেল বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পান এবং অভিষেক ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে চার ইউকেট পান। রুবেলের ফিল্ডিংও ভালো ছিল। জাতীয় ক্রিকেট দলে ঢোকার আগে উন্মোচন ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নেন রুবেল। ওই টুর্নামেন্টে রুবেলের কারণেই উন্মোচন ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়। তারও আগে রুবেল ঢাকায় হিল্লোল ক্লাবের হয়ে তৃতীয় বিভাগে খেলেন। রুবেলের দুর্দান্ত বোলিং দেখে ওই সময় অনেকে তাঁকে বাঘ বলে ডাকত।
বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুলের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক নিকুঞ্জ বিহারী হীরা জানান, রুবেল তাঁদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। শুরু থেকেই রুবেলের বলে অনেক গতি ছিল। এ কারণে রুবেলকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। রুবেলের কারণে তাঁরা স্কুল জেলা পর্যায়ের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন।
বাগেরহাট ইয়াং উন্মোচন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও বাগেরহাট পৌরসভার মেয়র খান হাবিবুর রহমান জানান, রুবেল বাগেরহাট তথা বাংলাদেশের গর্ব। রুবেলের দেখাদেখি বাগেরহাটে আরো রুবেল সৃষ্টি হবে। রুবেলের মা রমেজান বিবি জানান, তিন বছর বয়সের সময় থেকেই রুবেল খেলাধুলায় ঝুঁকে পড়ে। বল আর ব্যাট ছিল তার সারাক্ষণের সঙ্গী। রুবেল আজ বাংলাদেশের গর্ব। তিনি আশা করেন, রুবেল দেশকে একদিন বিশ্বকাপ এনে দেবে।
রুবেলের বাবার নাম সিদ্দিকুর রহমান। তাঁরা তিন ভাই, দুই বোন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রুবেল সবার ছোট। বড় ভাই সাগর হোসেন ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেঝভাই কবির হোসেন ব্যবসায়ী।
মাঠে নৈপুণ্য দেখিয়ে চান্স পেলেন অনূর্ধ্ব ১৯ দলে। ধারাবাহিক সাফল্যের হাত ধরে জাতীয় দলে খেলছেন। তারপর শুধুই সামনে এগোনোর পালা।

Previous
Next Post »
Thanks for your comment