ভাত না খেলে নাকি বাঙালির একদিনও চলে না। দেশের বাইরে গেলেও একমুঠো ভাতের জন্য আনচান করে প্রাণ। আজকাল অবশ্য অনেকেই ডায়েট করতে গিয়ে ভাত না খেয়ে রুটি খান। ভাত বা রুটি যাই হোক না কেন শর্করা জাতীয় খাবার দুই বেলায় না হলে বাঙালির উদরপূর্তি আর পুষ্টি বৃদ্ধি হয় না।
এটুকু পড়ার পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গোঘাটের বাসিন্দা অনিমা চক্রবর্তীর ঘটনা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন নিশ্চিত। স্রেফ চা, পানি আর হরলিক্স খেয়েই দিব্যি জীবন কাটাচ্ছেন ষাটোর্ধ এই নারী। এনটিভি অনলাইনকে অনিমা জানান, শেষ ৩৫ বছর চা-পানি আর হরলিক্স ছাড়া কিছুই খাননি তিনি।
হুগলি জেলার শ্যামবাজার পঞ্চায়েতের বেলডিহি গ্রামের বাসিন্দা অনিমা চক্রবর্তীর জীবনকাহিনী একটু বেদনাবিধুরই বটে। ৪৫ বছর আগে স্বামীর সংসারে আসার পর দারিদ্র্য কী তা ভালোমতোই বুঝতে পারেন তিনি। স্বামী গোপাল চক্রবর্তী ছিলেন পুরোহিত। বিভিন্ন যজমানের বাড়িতে পূজা-অর্চনা করে কায়ক্লেশে চলত সংসার।
স্বামীর কাজে সাহায্য করার জন্য একসময় অনিমাদেবী তাঁর নিজের গ্রাম থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে পাণ্ডুগ্রামে একটি বাড়িতে রাঁধুনির কাজ করা শুরু করেন। কিন্ত তাতেও সংসার সচ্ছ্লতা ফিরে না আসায় দিনের বাকি অবসরে এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন তিনি। হাড়ভাঙা এই পরিশ্রম করতে গিয়ে অনিমা দেবীর খাওয়া-দাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এমন দিনও যায় যেদিন তিনি নিজে সম্পূর্ণ আনাহারে থেকে পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন। আর যেদিন খাবার জুটেছে সেদিন হয়তো আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে।
বাড়িতে অভুক্ত শিশু সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে বাইরে যেটুকু যা খাবার পেতেন তা নিয়ে সোজা চলে আসতেন বাড়িতে। এভাবেই দিনের পর দিন কাটতে থাকে অনিমা দেবীর। আজ জীবনের মাঝ বয়েস পেরিয়ে এসে অনিমাদেবী নিজের মুখেই জানালেন, কখনো না খেয়ে কখনো বা আধপেটা খেয়ে- এভাবেই চলছিল দিন। এরমধ্যে হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন অনিমা।
টানা পাঁচদিন কিছুই খেতে পারেননি তিনি। ভাত, মুড়ি, রুটি যাই খান, সাথে সাথে বমি হয়ে যায়। শেষে ছুটে গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন, পেটে গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়েছে। কিন্তু এই রোগের চিকিৎসার সামর্থ্য ছিল না দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের। ফলে বাধ্য হয়ে ভারি খাবার খাওয়া ছেড়ে দিয়ে শুধু তরল খাবার খেতে লাগলেন অনিমা। এভাবে একসময় সেরেও উঠলেন তিনি।
তারপর থেকে কেটে গেছে দীর্ঘ ৩৫টি বছর। অনিমাদেবী বলেন, ‘এতগুলো বছর ধরে সারা দিনে একবার হরলিক্স, দুই কাপ চা, গ্লুকোজ আর জল খেয়েই কাটাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমদিকে কিছুদিন দু-একবার ভাত-রুটি-মুড়ি খাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্ত কিছু খেলেই পেটের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে যেত। বরং না খেয়েই সুস্থ থাকতাম আমি। কাজকর্ম করতেও কোনো অসুবিধা হতো না। তারপর সেই অভ্যাসকে নিয়ম করে ফেলেছি। এখন আর ভাত কিংবা ভারি কোনো খাবার খেতে খুব বেশি ইচ্ছেও করে না। এই চা-পানি খেয়েই তো দিব্যি সুস্থ রয়েছি।’
অনিমা দেবীর এই অদ্ভুত খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে হুগলির গোঘাটা ব্লক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুদীপ্ত মণ্ডল বলেন, এর মধ্যে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন গড়ে ২০০০ কিলো ক্যালোরি শক্তির প্রয়োজন হয়৷ যে শক্তি অনিমা দেবী খাবারের মধ্যে থেকে পেয়ে যাচ্ছেন, যার ফলে তাঁর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আরএলইএইচ মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালের লেকচারার সুশান্ত কুমার সরকার জানান, খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ কম খান, আবার কেউ বেশি খেয়েও দিন কাটান। তবে এই ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। চা এবং দুধ জাতীয় লিকুইড খাবারে প্রোটিন এবং অন্যান্য ক্যালোরিও রয়েছে। তাই, ওই মহিলার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।
ConversionConversion EmoticonEmoticon